রাইটার্স বিল্ডিং : ঐতিহ্যময় লালবাড়ি
কলকাতার হৃৎকেন্দ্রে, লালবাজারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক স্থাপনা— রাইটার্স বিল্ডিং। ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা, যাঁদের ‘লেখক’ বা writers বলা হতো, তাঁদের থাকার জন্য এই ভবন নির্মিত হয়। সেই থেকেই নাম হয় Writers’ Building। ফরাসি স্থপতি থমাস লায়ন ছিলেন এর প্রধান নকশাকার। শুরুতে সাদামাটা একটি বহুতল দালান হিসাবে নির্মাণ শুরু হলেও পরে ধাপে ধাপে এর সম্প্রসারণ ঘটে, যুক্ত হয় বিশাল করিডর, খিলান, স্তম্ভ ও কারুকার্যময় ভাস্কর্য। যাতে ফুটে উঠেছে গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর আইকনিক ভার্জিনিয়া স্টাইলের ছাপ। কিন্তু এটি শুধু একটি ভাস্কর্যময়ী স্থাপত্যের নিদর্শনই নয়, বাংলার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।ঔপনিবেশিক আমলে রাইটার্স বিল্ডিং ছিল বঙ্গ-প্রশাসনের প্রধান কার্যালয়। ব্রিটিশ অফিসারদের অফিস, সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শাখা, এবং নানা দপ্তরের কার্যকলাপ এখান থেকেই পরিচালিত হতো। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয় হিসেবে দীর্ঘদশক এটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই ভবনই ছিল বাংলার প্রশাসনিক হৃদয়।আবার এই রাইটার্স বিল্ডিং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর এই বিখ্যাত রাইটার্স বিল্ডিং এ ঢুকে বাঙলার তিন তরুণ বিপ্লবী— বিনয়, বাদল ও দিনেশ হত্যা করেন বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত তৎকালীন 'ইনস্পেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস' কর্ণেল এন.এস. সিম্পসন নামের ব্রিটিশ অফিসারকে। তাঁদের সেদিনের আত্মবলিদান রাইটার্স বিল্ডিংকে স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত করে। ভবনের সামনে তাঁদের ভাস্কর্য সেই সংগ্রামী মুহূর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।২০১৩ সালে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, রাইটার্স বিল্ডিংকে আর সচিবালয় হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। সমস্ত সরকারি দপ্তর স্থানান্তরিত হয় নবান্নে। বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ চলছে, যাতে এটি ভবিষ্যতে ঐতিহ্য কেন্দ্র, জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক পরিসর হিসেবে বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে।রাইটার্স বিল্ডিং কলকাতার স্থাপত্য ইতিহাসের গর্ব, ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক, আবার স্বাধীনতার সংগ্রামেরও স্মৃতিচিহ্ন। প্রশাসন ও রাজনীতি, আন্দোলন ও ঐতিহ্যের মিলিত কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এই ভবন আমাদের অতীতের এক অমূল্য দলিল হয়ে আছে।
যোগাযোগ করতে মেইল করুন
mailthescroll@gmail.com
